ধর্ষণের অপরাধ মৃত্যুদণ্ড, নতুন অধ্যাদেশ। ধর্ষণ কি? অধিকাংশ বিচারব্যবস্থায় ধর্ষণ বলতে কোনো ব্যক্তি কর্তৃক অন্য কোনো ব্যক্তির অনুমতি ব্যতিরেকে তার সঙ্গে যৌনসঙ্গমে লিপ্ত হওয়া কিংবা অন্য কোনোভাবে তার দেহে যৌন অনুপ্রবেশ ঘটানোকে বুঝায়।
এই পোস্টের বিষয়বস্তুসমূহ:
ধর্ষণের অপরাধ মৃত্যুদণ্ড নতুন অধ্যাদেশ
বাংলাদেশে নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইন সংশোধন করে ধর্ষণের সর্বোচ্চ শাস্তি হিসেবে মৃত্যুদণ্ডের বিধান সংক্রান্ত একটি অধ্যাদেশে সই করেছেন বাংলাদেশের রাষ্ট্রপতি। রাষ্ট্রপতির অধ্যাদেশের ফলে সংশোধিত আইনটি এখ্ন থেকেই কার্যকর হিসেবে জারি হল। ধর্ষণ এবং যৌন নিপীড়নের বিরুদ্ধে দেশজুড়ে প্রতিবাদ এবং বিক্ষোভের পর সোমবার আইনের সংশোধনীটি অনুমোদন করে বাংলাদেশের মন্ত্রিসভা।
ধর্ষণের অপরাধ মৃত্যুদণ্ড রাষ্ট্রপতির জারি করা নতুন এই অধ্যাদেশে
২০০০ সালের নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইনের ধর্ষণ, ধর্ষণ জনিত কারণে মৃত্যু শাস্তি ইত্যাদি প্রসঙ্গে ৯ (১) ধারায় বলা হয়েছে, বাংলাদেশে ধর্ষণের সর্বোচ্চ শাস্তি এতদিন ছিল যাবজ্জীবন কারাদণ্ড। তবে ধর্ষণের শিকার নারী বা শিশুর মৃত্যু হলে বা দল বেধে ধর্ষণের ঘটনায় নারী বা শিশুর মৃত্যু হলে বা আহত হলে, সর্বোচ্চ শাস্তি ছিল মৃত্যুদণ্ড অথবা যাবজ্জীবন কারাদণ্ড। সেই সঙ্গে উভয় ক্ষেত্রেই ন্যূনতম এক লক্ষ টাকা করে অর্থ দণ্ডের বিধানও রয়েছে। সেই আইনেই পরিবর্তন এনে ধর্ষণ প্রমাণিত হলেই মৃত্যুদণ্ড বা যাবজ্জীবনের বিধান রাখা হয়েছে। সেই সঙ্গে অর্থদণ্ডের বিধানও থাকছে।
প্রথমে ২০০০ সালে জারি করা নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইনের ৩৪টি ধারার মধ্যে ১২টি ধারাতেই বিভিন্ন অপরাধের শাস্তি হিসাবে মৃত্যুদণ্ড দেয়ার বিধান ছিল। তবে পরবর্তীতে অ্যাসিড নিয়ন্ত্রণ ও মানব পাচার সংক্রান্ত দুইটি আইনের অংশ আলাদা হয়ে যাওয়ার পর এই আইন থেকে বাদ দেয়া হয়। ফলে এই আইনের সাতটি ধারায় মৃত্যুদণ্ডের বিষয়টি বহাল থাকে।
নতুন অধ্যাদেশে ৯ (১) ধারাটি সংশোধন করে যাবজ্জীবন অথবা মৃত্যুদণ্ডের বিধান আনা হয়েছে।
এর আগে এই ধারায় বলা হয়েছিল যে, যদি কোন পুরুষ নারী বা শিশুকে ধর্ষণ করে, তাহলে তিনি যাবজ্জীবন সশ্রম কারাদণ্ডে দণ্ডিত হবেন এবং অতিরিক্ত অর্থদণ্ডে দণ্ডিত হবেন।
বাংলাদেশের মন্ত্রিপরিষদ সচিব জানিয়েছেন, এখন আইন সংশোধন করে ‘যাবজ্জীবন সশ্রম কারাদণ্ডের’ বদলে ‘ মৃত্যুদণ্ড বা যাবজ্জীবন সশ্রম কারাদণ্ড’ শব্দগুলো প্রতিস্থাপিত হয়েছে।
অধ্যাদেশে ৮ নং ধারার ৩২ সংশোধন করে ‘অপরাধের শিকার ব্যক্তির মেডিকেল পরীক্ষা’ শব্দের পরিবর্তে অপরাধে অভিযুক্ত ব্যক্তি এবং ‘অপরাধের শিকার ব্যক্তির মেডিকেল পরীক্ষা’ প্রতিস্থাপিত করা হয়েছে। অর্থাৎ এখন থেকে যিনি ধর্ষণের শিকার হয়েছেন, তার মেডিকেল পরীক্ষার পাশাপাশি যার বিরুদ্ধে অভিযোগ, তারও মেডিকেল পরীক্ষা করাতে হবে।
বাংলাদেশের আইনমন্ত্রী বলেছেন, ধর্ষণের সাজা মৃত্যুদণ্ড করায় এই অপরাধ কমে আসবে বলে তিনি বিশ্বাস করেন।
সংসদ চলমান না থাকায় সংশোধিত আইনটি অধ্যাদেশ আকারে জারি করার সিদ্ধান্ত নেয় সরকার।
তবে বাংলাদেশের সুপ্রিম কোর্টের জ্যেষ্ঠ আইনজীবী শাহদীন মালিক আশঙ্কা প্রকাশ করেন যে, এর আগেও এই আইনে কয়েকটি অপরাধে মৃত্যুদণ্ডের সাজা রয়েছে। তার সঙ্গে নতুন একটি ধারায় মৃত্যুদণ্ড যোগ করে সমস্যার সমাধান আসবে না।
ইরান, সৌদি আরব, মিশর, ইরাক, বাহরাইন ও উত্তর কোরিয়ার মতো বেশ কয়েকটি দেশে ধর্ষণের অপরাধে মৃত্যুদণ্ডের বিধান রয়েছে।
অধিকাংশ ধর্ষণের মামলায় ‘শাস্তি হয় হত না আগে
বাংলাদেশে ধর্ষণের ঘটনার অনুপাতে মামলার সংখ্যা কম৷ মানবাধিকার সংস্থা আইন ও সালিশ কেন্দ্রের (আসক) গত তিনবছরের পরিসংখ্যানে উঠে এসেছে এই চিত্র৷
সংস্থাটির হিসেবে চলতি বছরের জানুয়ারি থেকে অক্টোবর পর্যন্ত সারাদেশে এক হাজার ১৭৮ জন নারী ধর্ষণের শিকার হয়েছেন৷ ধর্ষণের পর হত্যা করা হয়েছে ৪৩ জন নারীকে৷ আর আত্মহত্যা করতে বাধ্য হয়েছেন আট জন৷ কিন্তু মামলা হয়েছে মাত্র ৮১৩টি৷
২০২০ সালে এক হাজার ৬২৭ জন নারী ধর্ষণের শিকার হয়েছেন
২০২০ সালে এক হাজার ৬২৭ জন নারী ধর্ষণের শিকার হয়েছেন৷ ধর্ষণের পর হত্যা করা হয়েছে ৫৩ জনকে৷ আত্মহত্যা করতে বাধ্য হয়েছেন ১৪ জন৷ আর মামলা হয়েছে এক হাজার ১৪৪টি৷ আর ২০১৯ সালে ধর্ষণের শিকার হয়েছেন এক হাজার ৪১৩ জন৷ ধর্ষণের পর হত্যা করা হয়েছে ৭৬ জনকে৷ আত্মহত্যা করতে বাধ্য হয়েছেন ১০ জন৷ মামলা হয়েছে ৯৯৩টি৷ আসক সংবাদমাধ্যমে প্রকাশিত খবরের ভিত্তিতে পরিসংখ্যান তৈরি করে৷ তবে অনেক ঘটনা সংবাদমাধ্যমে আসে না৷ আর যেসব খবর সংবাদমাধ্যমে আসে সেসব ঘটনায় ২০-৩০ ভাগ মামলা হয় না৷ কারণ সেগুলো স্থানীয়ভাবে মিটমাট করে ফেলা হয় বলে জানিয়েছে আসক৷ সংগঠনটির সাধারণ সম্পাদক মানবাধিকার কর্মী নূর খান বলেন, ‘‘বাংলাদেশে ধর্ষণসহ নারীর প্রতি সহিংসতার যত মামলা হয় তার সর্বোচ্চ চার থেকে পাঁচ ভাগ মামলায় আসামিরা শাস্তি পান৷ আর শুধু ধর্ষণের হিসাব করলে এই হার আরো অনেক কম হবে৷
ধর্ষণে সব সময় যৌনসুখ মুখ্য নয়
- সাইকোলজি অফ ভায়োলেন্স জার্নালের প্রতিষ্ঠাতা সম্পাদক শেরি হামবির মতে, ‘‘ধর্ষণ যৌনসুখের উদ্দেশ্যে নয়, বরং অপরপক্ষকে দমিয়ে রাখতে ক্ষমতার প্রদর্শন হিসাবে করা হয়৷’’ কিছু ক্ষেত্রে এই ক্ষমতার প্রকাশ শুধু নারীদের বিরুদ্ধে হয়৷ অন্যদিকে, ধর্ষণ কাজ করে তরুণ প্রজন্মের মধ্যে ‘জাতে ওঠার’ পন্থা হিসাবে৷ এছাড়া ধর্ষণের পেছনে রয়েছে নানাবিধ মনস্তাত্ত্বিক বিশ্লেষণ, যা বুঝতে বিজ্ঞানীরা নানা ধরনের গবেষণা চালিয়ে যাচ্ছেন৷
ধর্ষক কেন, কী ভেবে ধর্ষণ করে গবেষণার প্রাসঙ্গিকতা
মানবাধিকার ফাউন্ডেশনের প্রধান নির্বাহী নারী নেত্রী অ্যাডভোকেট এলিনা খান বলেন, ‘‘ধর্ষণ মামলায় সর্বোচ্চ দুই ভাগের বেশি শাস্তি হয় না৷” তিনি বলেন, ‘‘শাস্তির হার এত কম দেখে কেউ কেউ বলেন অধিকাংশ ধর্ষণ মামলাই মিথ্যা৷ কিন্তু তারা ঠিক বলছেন না৷ আদালতে আসামির বিরুদ্ধে অভিযোগ প্রমাণ না হলে ধর্ষণের ঘটনা মিথ্যা হয়ে যায় না৷ মামলা দায়ের থেকে শুরু করে মামলার তদন্তসহ নানা কারণে আসামিরা বেনিফিট অব ডাউটের সুযোগে ছাড়া পেয়ে যান৷” আইন বিশ্লেষকরা মনে করেন, বাংলাদেশে ধর্ষণ মামলায় মেডিকেল প্রতিবেদনকে সবচেয়ে বেশি গুরুত্ব দেয় আদালত৷ কিন্তু ধর্ষণের শিকার নারী ও পারিপার্শ্বিক সাক্ষ্য বা ঘটনা পরম্পরাকে গুরুত্ব দেয়া হয় না৷ ফলে অনেক আসামিই ছাড়া পেয়ে যান৷
এলিনা খান বলেন, ‘‘ধর্ষণের শাস্তি মৃত্যুদণ্ড করায় বিষয়টি আরো জটিল হয়ে পড়েছে৷ বিচারকরা এখন আরো বেশি সতর্ক হয়ে গেছেন৷ যেহেতু মৃত্যুদণ্ডের বিষয় তাই তারা কোনো ধরনের বেনিফিট অব ডাউট পেলেই খালাস দিয়ে দিচ্ছেন৷” শাস্তির চেয়ে যেটা আগে বেশি প্রয়োজন তা হলো মামলা, মামলার তদন্ত – এই বিষয়গুলো ঠিকভাবে করা৷ আমাদের এখানে সব কিছুই যেন ধর্ষকের পক্ষে,” বলেন তিনি৷
- আরও পড়ুন:
- ইভ টিজিং এর শাস্তি কি
এছাড়াও আপনারা আমাদের সাইটে জানতে পারবেন নিত্য নতুন নিয়োগ, সরকারি চাকরি, বেসরকারি চাকরি, বিজ্ঞপ্তি, শিক্ষা নিউজ, তথ্য, আইন , দর্শনীয় স্থান ইত্যাদি । সবার আগে এসব সম্পর্কে জানতে আমাদের ফেসবুক পেইজটি লাইক দিয়ে আমাদের সাথে থাকুন।